ads

মুক্তিযুদ্ধের আত্মজীবনী লেখক মেহেদী সাত্তার ঃ
গতকাল এক নিউজ  লিঙ্কের প্রতিবেদন পড়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমার অংশ নেবার স্মৃতি ফিরে পেয়েছিলাম। আগষ্ট মাসের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত রনাঙ্গনে ছিলাম।। এই সময়ে দুইটা সম্মুখ সমরে নাপাকি বাহিনীর সাথে মুখোমুখি হয়েছিলাম। বড়্গাছি, ছোট জামবাড়িয়া আর বড় জামবাড়িয়া নাপাকি বাহিনীর দখল মুক্ত করার যুদ্ধটা ছিল প্রতিবেদনে লেখা যুদ্ধটার মত। তবে আমাদের সাথে ট্যাংক ছিল না। কারণ ভারত তখনও যুদ্ধে সরাসরি জড়ায় নি। সারাদিন ধরে চলেছিল যুদ্ধটা। শেষ বিকেলে নাপাকি বাহিনী রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে গেছিল। আমার কালকের মন্তব্যের জের ধরে কুতুব নুটু লিখেছে;



"সাত্তার ভাই একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমাদের গ্রাম যেদিন পাক-হানাদার বাহিনী দখল করে ফেলে সেদিন মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা সম্মুখ যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের এলাকা শত্রু মুক্ত করে। ওই দিন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে তিনিও সেই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ও সাত্তার ভাই সহ তাঁদের দলের প্রতিটি সদস্যের প্রতি আমরা সত্যিই কৃতজ্ঞ।"
 ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের হুকুমে আমরা তার ১০জন স্পেশাল এ্যাটাক ফোর্স খুব ভোরেই বড়গাছি পৌঁছে গেছিলাম। নাপাকি বাহিনীর অবস্থান জেনে তাদেরকে উল্টা দিক দিয়ে আক্রমন করার জন্য আমার বিলের পাড়ে আম বাগানের ভিতর থেকে অনবরত গুলি ছুড়েছিলাম। সন্ধ্যার আগেই নাপাকি বাহিনী আর তাদের নেংটি কুকুর রাজাকারেরা লেজ তুলে পালিয়েছিল।

সেই সন্ধ্যায় এক দুঃখ জনক ঘটনা ঘটেছিল। শত্রুর পালিয়ে যাবার ব্যাপারটা নিশ্চিত হতেই আমরা বড়গাছি হাই স্কুলে গিয়ে বসে ছিলাম। হঠাৎ খবর এলো আমরা যে আম বাগান থেকে আক্রমন করেছিলাম সেখানে কয়েকজন রাজাকার লুকিয়ে আছে। অস্ত্র হাতে নিয়ে দিলাম আমরা সেদিক পানে ছিড়ে দৌঁড়। গিয়ে দেখলাম কয়েকজন লোক জিনিস পত্র ভাগাভাগি করছে। সবাইকে পাকড়াও করা হলো। ওদের কাছ থেকে জানলাম ওরা বিলের ওপারের গ্রাম চৌডালা থেকে লুটপাট করতে এসেছিল। তাদের কাছে কোন অস্ত্র নাই। আমাদের দলের নেতা সিদ্ধান্ত দিল ওদের সবাইকে গুলি করে হত্যা করতে। লুটেরাদের একপাশে লাইন করে দাঁড়াতে হুকুম দেয়া হলো। আমার সাথি মুক্তিযোদ্ধারা লুটেরাদের উল্টা পাশে দাঁড়িয়ে রাইফেল তাক করে ফায়ার করার জন্য অতি উল্লাসে প্রস্তুত হলো। দলনেতা ‘ফায়ার’ বলার সাথে সাথে গুলি ছুড়া শুরু করলো। আমি গুলি করছি না দেখে দলনেতা তেড়ে এসে বললেন, ফায়ার করো। আমি দৃঢ় কন্ঠে বললাম, আমি নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করতে পারবো না। ওরা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসে নি। আমার কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে দলনেতা অশ্লিল শব্দে গালি দিয়ে বললে, বড় মানব দরদি হয়েছে। আমি চুপ করেছিলাম।

বীর বাহাদুরেরা মনের খায়েশে নিরস্ত্র মানুষদের গুলি করে তাদের দেহ ছিন্ন বিছিন্ন করছে আর আমি খুব মন খারাপ করে দেখছি। হঠাৎ অনুভব করলাম আমার পিছন দিকে পানিতে ভেজা কিছুর স্পর্ষ। পিছন ফিরে দেখি সাদা পায়জামা পরা, মুখ ভর্তি দাড়ি, পানিতে ভিজা একটা লোক আমার গা ঘিষে দাড়িয়ে আছে। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই অন্যেরা এসে লোকটাকে গুলি করার জন্য টানা হ্যাচড়া শুরু করে দিল। লোকটা আমাকে জড়িয়ে ধরে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বললে, আমাকে বাঁচাও। আমি ছিলাম দলের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। লোকটাকে ধরে রাখতে পারলাম না। সবাই তাকে টেনে হিচড়িয়ে নিয়ে যেতে থাকলো। ভয়ার্ত লোকটা বারবার হাত বাড়িয়ে ‘আমাকে বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও বলে চিৎকার করতে থাকলো। তবুও কারো মনে দয়া হলো না। তার বুকে গুলি করলো অতি উৎসাহি মুক্তিযোদ্ধারা। মাটি লুটিয়ে পড়ে লোকটা ছটপট করতে থাকলো।

কিছুক্ষনের মধ্যেই কয়েক জন কোথা থেকে কোদাল নিয়ে এলো। কিছু দুরে মাটি খুঁড়ে বিরাট গর্ত করে সব মৃতদেহ তার মধ্যে ফেলে দিল। সব শেষে ফেলা হলো আমাকে যে লোকটা জড়িয়ে ধরেছিল তার দেহ। মাটি চাপা দেয়া শেষ হতেই লোকটা তার বাম হাত মাটি থেকে বের করে নাড়াতে শুরু করলো। সেটা দেখেই আমার সঙ্গিরা আবার গুলি করলো তার বুকে। একটু পরে নিথর হয়ে মাটির উপর গেল হাতটা। সবাই চলে গেল। আমি মন খারাপ করে কিছুক্ষন সেখানে দাড়িয়ে রইলাম। মনে হতে থাকলো, এই লোকগুলোর কেউ ছিল কারো বাবা, কেউ ছিল কারো চাচা, কেউ ছিল কারো স্বামি, কিম্বা কেউ ছিল কারো ভাই। তাদের পরিবারের কেউ কোনদিনও জানবে না কী ঘটেছিল তাদের আপন জনদের।

মন খারাপ করে ফিরে এলাম স্কুলে। সেখানেও কেউ নাই। অন্ধকার হয়ে এসেছে চারিদিক। হঠাৎ দেখি একটা ছোট বাচ্চা দাঁড়িয়ে কাঁদছে। গায়ে হাফ প্যান্ট আর হাফ সার্ট। ঠান্ডায় কাঁপছে। আমার নিজের গায়ে লুঙ্গি, একটা সুতির সার্ট আর একখান গামছা। গামছটা খুলে বাচ্চাটার গায়ে জড়াতে যাচ্ছি তখন পাশ দিয়ে যাওয়া একজন টিটকারি করে বললে, খুব মায়া দেখাইছো যে! গায়ে না মেখে বাচ্চাটাকে স্কুলের ভিতরে নিয়ে একটা বেঞ্চে শুইয়ে দিলাম। ঠান্ডা বেশ পড়ছিল। সুতির সার্ট দিয়ে ঠান্ডা ঠেকানো যাবে না। বাড়তি কাপড়ের সন্ধানে রওয়ানা হলাম গ্রামের দিকে। কিন্তু চারিদিকে ঘোর অন্ধকার। কোন লোকজন নেই কোন বাড়িতে। কিছুদুর এগুতে একটা ঘরে আলো দেখতে পেলাম। কাছে গিয়ে দেখি দুই বুড়া, বুড়ি আর একটা বাচ্চা ছেলে। তারা কুপির আগুনের পাশে বসে আছে। জিজ্ঞেস করলাম একটা চাদর, কবল, বা ক্যাথা পাওয়া যাবে কিনা। বুড়া লোকটা বললে তেমন কিছু নাই। তবে একটা পুরানা গাদলা আছে। গাদলাটা কাঁধে ফিরে এলাম স্কুলে। একটা বেঞ্চে শুয়ে গাদলা গায়ে দিতে গিয়ে দেখি ওটা ছেঁড়া, ফাটা, জরাজির্ণ আর ভিতর থেকে পচা দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। ওটা গায়ে দেয়া মানে দম বন্ধ হয়ে মরে যাওয়া। গাদলাটা বাইরে ফেলে দিয়ে এসে বেঞ্চের উপর শুয়ে বসে রাত পার করলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বাচ্চা ছেলেটা স্কুলে নাই। কোথায় যেন চলে গেছে। আবার মন খারাপ হলো। আজও জানি না ছেলেটা ঘরে ফিরে যেতে পেরেছিল কিনা। যুদ্ধ কখনও শান্তি আনে না, আনে না কোন মঙ্গল। সেই ছেলেটার মত কত শত ছেলে মায়ের বুক খালি করে কোথায় হারিয়ে গেছে কেউ তার খবর রাখে নি।

এসবের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীন দেশে লুটেরারা করে চলেছে পুকুর চুরি, সাগর চুরি। এখন আর অতি উৎসাহি মুক্তিযোদ্ধারা এইসব লুটেরাদের লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারতে পারে না। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। তাই এখন মন খারাপ হলেও আগের মত কিছুই করার নাই। আমি অতি ছোট চুনোপুটি!!

,মেহেদী সাত্তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে সংগ্রহীত

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন

Ads